নিখোঁজের আট দিন পর ফিরে আসা ধর্মীয় বক্তা আবু ত্ব-হা আদনান ও তাঁর দুই সঙ্গীকে রংপুর মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের কার্যালয় থেকে আদালতে নেওয়া হয়েছে। আজ শুক্রবার রাত সাড়ে নয়টায় পুলিশ ভ্যানে করে চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রট আদালতে নেওয়া হয়েছে।
বিষয়টি নিশ্চিত করে কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবদুর রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, আবু ত্ব–হা স্বেচ্ছায় জবানবন্দি দিতে চাওয়ায় দুই সঙ্গীসহ তাঁকে আদালতে নেওয়া হয়েছে। আবু ত্ব–হার পরিবারের পক্ষ থেকে ইতিমধ্যে থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়েছে। আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
এর আগে শুক্রবার বিকেলে আবু ত্ব-হাকে তাঁর শ্বশুরবাড়ি থেকে এবং বাকি দুজনকে নিজ নিজ বাড়ি থেকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ নিয়ে যায়। পুলিশের দাবি, আবু ত্ব-হাসহ চারজন ব্যক্তিগত কারণে আত্মগোপনে ছিলেন। রংপুর নগরের সেন্ট্রাল রোডে অবস্থিত মহানগর পুলিশের উপকমিশনারের কার্যালয়ে প্রেস ব্রিফিংয়ে এসব তথ্য জানান উপকমিশনার (অপরাধ) আবু মারুফ হাসান। বিফ্রিংয়ে জানানো হয়, আবু ত্ব-হাসহ চারজন গাইবান্ধার ত্রিমোহনী এলাকায় ত্ব-হার বন্ধু সিয়ামের বাসায় ব্যক্তিগত কারণে আত্মগোপনে ছিলেন।তবে ত্ব-হাসহ তিনজনের পরিবারের কেউই এ বিষয়ে গণমাধ্যমের কাছে বিস্তারিত কিছু বলতে চাইছেন না। তবে তাঁদের একজনের পক্ষের আইনজীবী সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এম সরোয়ার হোসেন শুক্রবার রাতে প্রথম আলোকে বলেন, অতীত ইতিহাস থেকে দেখা গেছে, এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আর কেউ মুখ খোলেন না। যেমন বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদ ও সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজল।
১০ জুন রাত থেকে নিখোঁজ ছিলেন আবু ত্ব-হা আদনানসহ ওই চারজন। এ ঘটনায় ১১ জুন ত্ব-হার মা রংপুর কোতোয়ালি থানায় জিডি করেন। ত্ব-হা সপরিবার রংপুর শহরে থাকেন। তাঁর মা আজেদা বেগম প্রথম আলোকে বলেছিলেন, তাঁর ছেলে অনলাইনে আরবি পড়ানোর পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন মসজিদে জুমার খুতবা দিতেন। ১০ জুন ঢাকার একটি মসজিদে খুতবা দেওয়ার উদ্দেশ্যে রংপুর থেকে বিকেল চারটার দিকে ভাড়া করা একটি গাড়িতে রওনা দেন। সঙ্গে ছিলেন তাঁর দুই সঙ্গী আবদুল মুহিত ও ফিরোজ আলম। এ ছাড়া গাড়ির চালকের নাম আমিরউদ্দিন ফয়েজ। ওই দিন রাত ২টা ৩৬ মিনিটে আদনানকে তাঁর স্ত্রী ফোন করলে তিনি বলেন, তিনি ঢাকার গাবতলীতে আছেন। মুঠোফোনের চার্জ প্রায় শেষ হয়ে গেছে। এরপর থেকে ত্ব-হাসহ সবার মুঠোফোনই বন্ধ ছিল।
প্রেস ব্রিফিংয়ে উপকমিশনার (অপরাধ) আবু মারুফ হাসান বলেন, ত্ব-হাসহ চারজন ১০ জুন দিবাগত রাতে ঢাকায় পৌঁছান। এরপর ওই রাতেই আশুলিয়া হয়ে আবার রংপুরের উদ্দেশ্যে রওনা হন। তবে তাঁরা গাইবান্ধায় চলে যান। সেখানে ত্রিমোহনী এলাকায় ত্ব-হার বন্ধু সিয়ামের বাসায় এই আট দিন আত্মগোপনে থাকেন তাঁরা। ১০ জুন দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে গাবতলী অবস্থানকালেই তাঁরা মুঠোফোন বন্ধ করে দেন। আট দিন তাঁদের মোবাইল ফোন বন্ধই ছিল।
এই পুলিশ কর্মকর্তা আরও জানান, গতকাল জুমার নামাজের পর ওই চারজনের মুঠোফোন চালু হয়। এরপর প্রত্যেকের পরিবারের পক্ষ থেকে পুলিশকে জানানো হয় যে তাঁরা সবাই বাড়ি ফিরে এসেছেন। তবে ত্ব-হা আদনান নিজের বাড়ি না গিয়ে শ্বশুরবাড়ি রংপুর নগরের বাবু খাঁ মাস্টারপাড়া এলাকায় আজহারুল মণ্ডলের বাসায় ওঠেন। বাকি তিনজনের মধ্যে গাড়িচালক আমিরউদ্দিনের বাড়ি রংপুর নগরের আশরতপুর এলাকায়। আবদুল মুহিতের বাড়ি রংপুরের মিঠাপুকুরের জায়গীর হাট এলাকায়। আর ফিরোজ আলমের বাড়ি বগুড়ার শিবগঞ্জের সাফিয়ানপাড়া এলাকায়।
ওই চারজনের পরিবারের পক্ষ থেকে পুলিশকে জানানোর পর পুলিশ ত্ব-হাকে তাঁর শ্বশুরবাড়ি থেকে বেলা পৌনে তিনটায় রংপুর কোতোয়ালি থানায় নেয়। এ ছাড়া আমিরউদ্দিন ও আবদুল মুহিতকে বিকেল সাড়ে চারটায় ওই থানায় নেওয়া হয়। সেখান থেকে তাঁদের মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনারের কার্যালয়ে নেওয়া হয়। এদিকে বগুড়ার শিবগঞ্জ থানা-পুলিশ ফিরোজকে উদ্ধার করে সেখানকার থানায় নেয়।
প্রেস ব্রিফিংয়ের আগে ত্ব-হার শ্বশুরবাড়িতে গেলে তাঁর শ্বশুর আজহারুল মণ্ডল কোনো কথা বলেননি। রংপুর নগরের সেন্ট্রাল রোডে ত্ব-হার নানাবাড়িতে গিয়েও কারও কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। ত্ব-হার মায়ের মুঠোফোনে ফোন দেওয়া হলে ফোন ধরেন তাঁর স্ত্রী আবিদা নূর। তিনি বলেন, ‘(শুক্রবার) দুপুর ১২টার দিকে এসেছে (ত্ব-হা) আমাদের বাড়িতে (শ্বশুরবাড়ি)। দুপুরে বাড়িতেই জুমার নামাজ আদায় করে ভাত খাওয়া শেষ হতেই পুলিশ এসে তাঁকে নিয়ে যায়। তার সঙ্গে এসব বিষয়ে কোনো কথা বলাও হয়নি। তার ফিরে আসাটাই আমাদের কাছে বড় পাওয়া। মনটা তার ভিশন খারাপ।’ এর বেশি কিছু বলতে চাননি ত্ব-হার স্ত্রী।
গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে রংপুর নগরের আশরতপুরে গাড়িচালক আমিরউদ্দিনের বাড়িতে গেলে সেই বাড়ি থেকে কেউ কিছু বলতে চাননি। বাড়ির ভেতর থেকে শুধু একটি পুরুষ কণ্ঠ জানায়, দুপুর ১২টার দিকে আমির বাড়িতে ফিরেছেন।
এদিকে বগুড়ায় প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, আবু ত্ব-হার সহযোগী ফিরোজ আলমের বাবা আনিছুর রহমান প্রথম আলোকে বলেছেন, তাঁর ছেলে বাড়ি না ফিরে গতকাল প্রথমে এক আত্মীয়ের বাসায় যান। এটুকু বলেই আনিছুর ফোনের লাইন কেটে দেন।
বগুড়ার শিবগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সিরাজুল ইসলাম বলেন, ফিরোজ আলম নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় ১৪ জুন তাঁর বাবা আনিছুর রহমান শিবগঞ্জ থানায় জিডি করেন। গতকাল সকালে ছেলে এলাকায় ফিরলেও থানায় কোনো তথ্য জানায়নি পরিবার। বাধ্য হয়ে একজন কর্মকর্তাকে থানা থেকে তাঁর বাড়িতে পাঠানো হয়েছিল। তাঁর স্ত্রী কামরুন নাহারও ফিরোজের ফিরে আসার বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
আবু ত্ব-হার বিষয়ে তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী সাবিকুন নাহারকে আইনি সহায়তা দিচ্ছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এম সরোয়ার হোসেন। তিনি শুক্রবার রাতে প্রথম আলোকে বলেন, গতকাল ফজরের নামাজের আগে ত্ব-হা অজ্ঞাত জায়গা থেকে তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রীকে ফোন করে বলেন, শনিবার সকালে তিনি রংপুরের বাড়িতে যাবেন। এ নিয়ে কারও সঙ্গে কোনো কিছু আলাপ না করতেও বলেন তিনি। ত্ব হা এ-ও বলেন, সাবিকুন নাহার তাঁর জীবন অস্থির করে তুলেছেন। বেলা তিনটায় সাবিকুন নাহার জানতে পারেন, ত্ব-হা রংপুরের বাসায় এসে গেছেন।