জাতির পিতার উন্নত-সমৃদ্ধ স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে বর্তমানে বাস্তবায়িত হচ্ছে রূপকল্প-২০৪১। আমরা সবাই জানি, উন্নত দেশ মানে শুধু দারিদ্র্য দূরীকরণ আর অর্থনৈতিক উন্নয়ন নয়, উন্নত দেশ মানে নাগরিকের প্রকৃত মানবিক উন্নয়ন। এ প্রসঙ্গে নোবেল জয়ী বাঙালি অর্থনীতিবিদ ড. অমর্ত্য সেন বলেছেন, ‘কোনো দেশের মানবিক অগ্রগতি না হলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন দীর্ঘ মেয়াদে বাধাগ্রস্ত হতে পারে’। চলমান অর্থনৈতিক উন্নয়ন দীর্ঘ মেয়াদে টেকসই করার উত্তম চর্চা হিসেবে সমাদৃত হয়েছে ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের শেখ হাসিনা মডেল’।
বাংলাদেশের সব কিছুর মতোই আশ্রয়ণ কার্যক্রমেরও শুরু হয়েছে জাতির পিতার হাত ধরে। ১৯৭২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি তিনি পরিদর্শন করেন বর্তমানের লক্ষ্মীপুর জেলার রামগতি উপজেলার চড়পোড়াগাছা গ্রাম। সেখানকার ভূমিহীন, গৃহহীন ও অসহায় মানুষকে পুনর্বাসনের নির্দেশনা প্রদান করেন। পরবর্তী সময়ে ১৯৯৭ সালের ১৯ মে তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরিদর্শনে যান ঘূর্ণিঝড়ে আক্রান্ত কক্সবাজার জেলা। গৃহহীন মানুষের দুর্দশা দেখে কাতর হয় প্রধানমন্ত্রীর মানবিক হূদয়। তাত্ক্ষণিক নির্দেশ দেন পরিবারসমূহকে পুনর্বাসনের। সেই থেকে শুরু ‘আশ্রয়ণ প্রকল্পে’র পথ চলা। জুন ২০২১ পর্যন্ত পুনর্বাসিত হয়েছে ৩ লাখ ৭৩ হাজার ৫৬২টি ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবার।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫ অনুচ্ছেদে বর্ণিত আছে, ‘১৫) রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হইবে. (ক) অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিত্সাসহ জীবনধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা’। প্রধানমন্ত্রীর ১০টি বিশেষ উদ্যোগের একটি ‘আশ্রয়ণ প্রকল্প’কে এতদিন বিবেচনা করা হতো জনসাধারণের ‘মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা’ করার দায়িত্ব হিসেবে। বর্তমানে তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নাগরিকের ‘মানবিক অধিকার’।
‘মুজিববর্ষে কেউ গৃহহীন থাকবে না’—প্রধানমন্ত্রীর এমন আহ্বানে সাড়া দিয়ে ‘গৃহহীনে গৃহদান’ কর্মসূচি রূপ নিয়েছে একটি সামাজিক আন্দোলনে। জেলা প্রশাসন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, ভূমি মন্ত্রণালয়, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার বিভাগের মাধ্যমে বাস্তবায়িত কর্মযজ্ঞ সমন্বয় করা হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ, সমাজের সচ্ছল লোকের অনুদান, সরকারের সচিবগণের অর্থায়নে নিজ জমিতে ঘর নির্মাণ, করপোরেট অনুদান গ্রহণের মাধ্যমে আশ্রয়ণ তহবিল গঠন ইত্যাদি বহুমাত্রিকতার দরুন মুজিববর্ষের এই বিশেষ উদ্যোগ রূপ নিয়েছে সামাজিক আন্দোলনে। অসহায়, দরিদ্র, ভিক্ষুক, বিধবা, স্বামী পরিত্যক্তা, গৃহহীন ছিন্নমূল যাদের ঘর-জমি কিছুই নাই তাদেরকে দেওয়া হয় সর্বোচ্চ প্রাধিকার, (ক-শ্রেণি)। যাদের সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ জমি আছে; কিন্তু ঘর নেই, থাকলেও জরাজীর্ণ তাদেরকে দেওয়া হয় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ প্রাধিকার (খ-শ্রেণি)। ক-শ্রেণিভুক্ত পরিবারে দেওয়া হয় দুই শতক খাস জমি আর টয়লেট, রান্নাঘর, বারান্দাসহ দুই কক্ষবিশিষ্ট ৩৯৪ বর্গফুটের একটি সেমিপাকা ঘর। শেষ ধাপে নির্মিত প্রতিটি ঘরের ভিত্তি ব্যয় ১ লাখ ৯০ হাজার টাকা। সঙ্গে আনুষঙ্গিক ব্যয় মিলিয়ে প্রতিটি ঘরের জন্য ব্যয় হয়েছে প্রায় ২ লাখ ৫ হাজার টাকা। দেওয়া হয়েছে স্বামী-স্ত্রীর যৌথ নামে ভূমির মালিকানা স্বত্বের দলিল/কবুলিয়ত ও নামজারি, বিদ্যুত্ সংযোগ ও নলকূপ।
প্রধানমন্ত্রী তার ‘গৃহহীনে গৃহদান’ কর্মসূচির মাধ্যমে যার কিছুই ছিল না তাকে করেছেন লাখপতি। ছিন্নমূলকে ক্ষমতায়ন করে বসিয়েছেন সম্মানের আসনে। এ প্রসঙ্গে MIT এর অর্থনীতি বিভাগ থেকে ১৯৯৯ সালে প্রকাশিত নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ অভিজিত্ ব্যানার্জির Prospects and Strategies for Land Reform নিবন্ধ থেকে বলা যেতে পারে, ‘Land is a source of political power and social prestige’। শুধু তাই নয়, বর্তমান সরকারের নির্বাচনি অঙ্গীকার, ‘গ্রাম হবে শহর; গ্রামেই পৌঁছে দেওয়া হবে শহরের সব সুবিধা’ বাস্তবায়নেও আশ্রয়ণ প্রকল্পের বর্তমান ধারা সাযুজ্যপূর্ণ। জমি ও গৃহ প্রদানের প্রধানমন্ত্রীর এই উদ্যোগ বিশ্বে প্রথম। কয়েকটি দেশে জমি কেনার জন্য স্বল্প সুদে ঋণ দেওয়া হয়, ঘরসহ জমির মালিকানা বাংলাদেশেই প্রথম।
ঋণনির্ভর গতানুগতিক উন্নয়ন মডেলে নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা। বছরের পর বছর ভাঙা ঘরে বাস করে স্বাস্থ্যহানি, ভাঙা ঘর মেরামত ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বাস করার ফলে বাড়তি চিকিত্সাব্যয় নির্বাহে সঞ্চয় ফুরিয়ে যাওয়া, সন্তানের লেখা পড়ার খরচ না চালাতে পারা, এনজিও থেকে উচ্চ সুদে নেওয়া ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে নাভিশ্বাস ছুটে যাওয়া, খাদ্যের চাহিদা মেটানো, প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে মোকাবিলা করে টিকে থাকা—এসবের ফলে তথাকথিত ‘সাহায্যনির্ভর উন্নয়ন মডেল’সমূহের সফলতার গল্প সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে যতটা শ্রুতিমধুর বাস্তবে তার ধারে কাছেও নেই। আর এই কারণেই হয়তো জাতির পিতা বলেছেন—‘বিদেশ থেকে ভিক্ষা করে এনে দেশকে গড়া যাবে না’। যা করার আমাদের নিজদেরই করতে হবে।
নাগরিকের আত্মনির্ভরশীলতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে ‘প্রকৃত মানবিক উন্নয়নের’ জন্য প্রকল্প এলাকায় নির্মাণ করা হয়েছে বিদ্যালয়, খেলার মাঠ, মসজিদ-মন্দির, করবস্থান, কমিউনিটি সেন্টার, কমিউনিটি ক্লিনিক, নলকূপ। গ্রোথ সেন্টারের পাশে নির্মিত প্রকল্পে আছে পুকুর, হাঁস-মুরগি, পশু পালনের ব্যবস্থা। সরকারের বিভিন্ন দপ্তর থেকে দেওয়া হচ্ছে প্রশিক্ষণ এবং সে অনুযায়ী সহজ কিস্তির ঋণ। তাদেরকে নেওয়া হয়েছে ভিজিএফ, মাতৃত্বকালীন ভাতা, বয়স্ক ভাতা ইত্যাদি সামাজিক নিরাপত্তার বেষ্টনীর আওতায়। ‘শেখ হাসিনা মডেল’ এর মূল চারটি বৈশিষ্ট্য; ১) উপার্জনক্ষমতা ও সঞ্চয় বৃদ্ধি করে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করা, ২) সম্মানজনক জীবিকা ও সামাজিক মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠা, নারীকে ঘরের অর্ধেক মালিকানা দিয়ে নারীর ক্ষমতায়ন, ৩) প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষতা ও সক্ষমতা বাড়িয়ে মানবসম্পদ উন্নয়ন ও উত্পাদনশীলতা বৃদ্ধি এবং ৪) ব্যাপক হারে বনায়ন ও বৃক্ষ রোপণ করে পরিবেশের উন্নতি সাধনের পাশাপাশি গ্রামেই শহরের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা।
আশ্রয়ণ প্রকল্পের বর্তমান ধারা অর্থনীতিতে রাখছে মাল্টিপ্লাইয়ার ইফেক্ট। করোনা অতিমারির সময় বিশ্ব অর্থনীতি যখন স্থবির, জীবন-জীবিকা নিশ্চল, দেশে দেশে ধেয়ে আসছিল অর্থনৈতিক মন্দা, তখন প্রধানমন্ত্রীর এই মানবিক উদ্যোগ অর্থনীতিতে সৃষ্টি করেছে নতুন নতুন চাহিদা।
উপকারভোগী নির্বাচন, উপযুক্ত খাসজমি বাছাই, ভূমির উন্নয়ন এবং গুণমান বজায় রেখে ঘর নির্মাণের বিশাল কর্মযজ্ঞ বাস্তবায়িত হচ্ছে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নেতৃত্বে সহকারী কমিশনার (ভূমি), উপজেলা প্রকৌশলী, উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা এবং সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের সমন্বয়ে পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট বাস্তবায়ন কমিটির মাধ্যমে। জেলা টাস্কফোর্সের সম্মানিত সদস্যবৃন্দ, সম্মানিত জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ, সাংবাদিকবৃন্দসহ বিভাগীয় কমিটি সবাই যুক্ত ছিলেন সময়ের এই মহত্ কাজে। ভবিষ্যতে প্রকল্পের পরিধি হয়তো আরো আকর্ষণীয় হবে। প্রকল্প এলাকা নিয়ে হতে পারে ‘টেকসই উন্নয়ন অভীক্ষা ঃ মডেল গ্রাম’। ভূ-প্রকৃতি, জলবায়ু, সংস্কৃতি, নাগরিকের আবাসন ব্যবহাররীতি ইত্যাদির ওপর নির্ভর করে পরিবর্তন আনতে হতে পারে ডিজাইন অথবা বরাদ্দে।
মহান এই কাজে কোনো ত্রুটিই কারো কাছে গ্রহণযোগ্য নয়, সেটা ১ শতাংশের নিচে হলেও নয়। তাই কোনোরূপ ত্রুটিবিচ্যুতি নজরে এলে তাত্ক্ষণিকভাবে প্রয়োজনীয় মেরামতের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। তথাপি, সমালোচনা থাকে, সমালোচনা থাকবেই, সমালোচনা বরং শুদ্ধতা লাভে সহায়ক। সমালোচনা মাথায় নিয়ে এগিয়ে যাবার পথে প্রধানমন্ত্রীই আমাদের সবার অনুপ্রেরণার অফুরান উত্স। জাতির পিতার উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি প্রায়শই বলে থাকেন, ‘আপনি যদি কোনো ভালো কাজ করেন তাহলে লোকে আপনার সমালোচনা করবেই। আম গাছে আম ধরে বলেই লোকে ঢিল ছোড়ে। ফজলি আম গাছে আরো বেশি ঢিল ছোড়ে। শেওড়া গাছে কেউ ভুলেও ঢিল ছোড়ে না’।