অবশেষে রুপিতে বাণিজ্য শুরুর নতুন যাত্রার অপেক্ষায় বাংলাদেশ ও ভারত; সাম্প্রতিক সময়ের ডলার সংকট দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘ সময় ধরে আলোচনায় থাকা বিকল্প এ লেনদেন মাধ্যমকে এবার বাস্তব রূপ দিচ্ছে।
প্রতিবেশী দেশ দুটির মধ্যে ডলারের মাধ্যমে এতদিন ধরে চলা বাণিজ্যিক লেনদেনে এবার যুক্ত হচ্ছে রুপি।
শুরুতে দুই দেশের দুটি করে চারটি ব্যাংকের মাধ্যমে রুপিতে আমদানি-রপ্তানি পণ্যের মূল্য পরিশোধ করা যাবে, যা মঙ্গলবার ঢাকার লো মেরিডিয়ান হোটেলে আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হবে।
বৈদেশিক বাণিজ্যে লেনদেন সহজ করতে এবং ব্যয় সাশ্রয়ে বিকল্প মুদ্রা চালুর দাবির প্রেক্ষিতে গত কয়েক মাস ধরে উভয় দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে আলোচনার পর সীমিত পরিসরে রুপিতে লেনদেন শুরু হচ্ছে।
এতে উভয় দেশের উদ্যোক্তাদের বাণিজ্য খরচ কমে আসার সঙ্গে ডলার নির্ভরতাও কিছুটা কমে আসবে বলে মনে করছেন ব্যাংকার, অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা।
শুরুতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ও বেসরকারি ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেড (ইবিএল) এবং ভারতের স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া (এসবিআই) ও আইসিআইসিআই ব্যাংক রুপিতে বাণিজ্য লেনদেনের নিষ্পত্তিতে অংশ নিচ্ছে।
মঙ্গলবার সকালে লো মেরিডিয়ানে বাংলাদেশ ব্যাংক ও ঢাকায় ভারতীয় দূতাবাসের যৌথ আয়োজনে আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের পাশাপাশি ইবিএলের প্রধান কার্যালয়ে বিকেল সাড়ে ৪টায় আরেক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। ইবিএলের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি থাকবেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম।
লেনদেন যে প্রক্রিয়ায়
প্রতিবেশী দুই দেশের মধ্যে রুপিতে লেনদেনের প্রক্রিয়া চালু করতে দুই দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদনে রুপিতে ভারতের ব্যাংকগুলোতে ‘নস্ট্র অ্যাকাউন্ট’ খুলেছে সোনালী ও ইবিএল। নস্ট্র হিসাব হল- এক দেশের কোনো ব্যাংকের বিদেশের কোনো ব্যাংকে বিদেশি মুদ্রায় লেনদেন করতে খোলা হিসাব।
এতদিন ডলারের মাধ্যমে এলসি বা ঋণপত্র খোলার চলে আসা নিয়মের পাশাপাশি রুপিতে বাংলাদেশ থেকে পণ্য আমদানির জন্য ভারতের ব্যাংক দুটিতে ঋণপত্র খুলতে পারবেন দেশটির আমদানিকারকরা।
একইভাবে ভারত থেকে পণ্য আমদানিতে বাংলাদেশের ব্যাংক দুটিতে ঋণপত্র খুলতে পারবেন স্থানীয় আমদানিকারকরা বলে জানিয়েছেন ইবিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলী রেজা ইফতেখার।
সোনালী ব্যাংকের বৈদেশিক বাণিজ্য বিভাগের শীর্ষস্থানীয় একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, টাকার বিপরীতে রুপিতে বিনিময় হার ব্যাংকগুলোকে সরবরাহ করে থাকে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ হার ধরে পণ্য আমদানি ও রপ্তানি খরচ নির্ধারণ করবে ব্যাংকগুলো।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত রোববার প্রতি ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হার ১০৯ টাকা। অন্যদিকে গত এপ্রিল শেষে ভারতের রুপির বিপরীতে টাকার বিনিময় হার ছিল ১ টাকা ২৬ পয়সা।
বিদেশি মুদ্রা লেনদেনে আর্থিক পরিষেবা হিসেবে আন্তর্জাতিক লেনদেন মাধ্যম সুইফট সিস্টেমকে ব্যবহার করা হয়। কোনো দেশের সঙ্গে বিদেশি মুদ্রায় বাণিজ্য লেনদেন নিষ্পত্তি করতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) স্বীকৃত মুদ্রায় করতে হয়। সুইফট সিস্টেমে এখনও রুপি অন্তভূক্ত করা হয়নি।
ইউএস ডলার, ইউরো, পাউন্ড, চীনের মুদ্রা ইউয়ান ও জাপানের ইয়েন আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের স্বীকৃত মুদ্রা। এর বাইরের কোনো মুদ্রায় লেনেদেন করতে হলে প্রয়োজন হয় দ্বিপক্ষীয় চুক্তি।
ইবিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলী রেজা ইফতেখার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সুইফটের পাশাপাশি আরটিজিএস মাধ্যমকে ব্যবহার করে রপ্তানির আয় নস্ট্র হিসাবে আনা ও আমদানি ব্যয় পুনরায় নস্ট্র হিসাব থেকে মেটানো হবে।
তার মতে, রুপিতে লেনদেন নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দেবে। এতে ডলারের উপর নির্ভরতা কমে গিয়ে উদ্যোক্তাদের খরচও কমে যাবে।
রুপির পাশাপাশি পরে লেনদেন নিষ্পত্তি প্রক্রিয়ায় টাকা যোগ হওয়ার আশা প্রকাশ করেন তিনি।
সুবিধা মিলবে কতটুকু
রুপিতে বাণিজ্য সম্পাদন হলে কয়েকটি সুবিধা পাবে বাংলাদেশ জানিয়ে আলী রেজা ইফতেখার বলেন, ডলার সংকট থাকায় দুই দেশই বিকল্প মুদ্রায় লেনদেন করা বাণিজ্যে লাভবান হবে। ডলারের মাধ্যমে ভারত থেকে আমদানি দায় মেটানো ও রপ্তানিতে দুইবার বিনিময় হার ঠিক করা লাগবে না। এতে বিনিময় হারজনিত ব্যয় কমবে।
একটি মুদ্রায় লেনদেন হওয়ায় তা দ্রুত নিষ্পত্তি করা যাবে বলেও জানান তিনি।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, এখন রুপিতে বাণিজ্য নিষ্পত্তি শুরু হলেও পরে ভারতীয় ঋণের অর্থে পণ্য আমদানিতে এ সুবিধা চালু করা যেতে পারে।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, ‘‘এখন শোনা যাচ্ছে বাংলাদেশ যে পরিমাণ পণ্য রপ্তানি করে ভারতে- যার পরিমাণ দুই বিলিয়ন ডলারের মত, এ পরিমাণ অর্থের বিপরীতে আমদানি দায় রুপিতে পরিশোধ করা হবে। এতে করে বাংলাদেশের সামগ্রিক বাণিজ্য লেনদেনে অর্থাৎ আমদানি ও রপ্তানিতে কিন্তু ডলারের পরিমাণ দুই বিলিয়ন কমে যাবে।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হক বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, এ দুই ব্যাংকের পাশাপাশি পরে অন্যান্য ব্যাংক যুক্ত হবে। রুপিতে লেনদেন করলে ব্যবসার খরচ কমে আসবে বলেও মনে করছেন তিনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ২০২১-২২ অর্থবছরে ভারত থেকে এক হাজার ৩৬৯ কোটি ডলার আমদানি দায় পরিশোধ করা হয়; যা মোট আমদানি ব্যয়ের ১৮ দশমিক ১০ শতাংশ। এর বিপরীতে রপ্তানি করা হয় ১৯৯ কোটি ডলার।
প্রাথমিকভাবে বাংলাদেশ যে পরিমাণ পণ্য ভারতে রপ্তানি করছে, সে পরিমাণ রপ্তানি আয়ের বিপরীতে পণ্য আমদানি দায় মেটানোর দাবি করছেন ব্যবসায়ীরা। রুপিতে বাণিজ্য শুরু হলে উদ্যোক্তাদের আগ্রহের উপর নির্ভর করছে বছর শেষে তা কতটুকু হবে।
এদিকে মঙ্গলবার আনুষ্ঠানিকভাবে লেনদেনের এ প্রক্রিয়া উদ্বোধন করা হলেও এখনও এ বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ কোনো নীতিমালা প্রকাশ করেনি বাংলাদেশ ব্যাংক। শুধু ভারতের দুই ব্যাংকে নস্ট্র হিসাব খোলার অনুমতি দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
সোনালী ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, ব্যাংকগুলোকে টাকা ও রুপির বিপরীতে ডলারের বিনিময় হার প্রতিদিন জানিয়ে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এ হার ধরেই পণ্য আমদানি ও রপ্তানির হিসাব করা হবে। নীতিমালা পেলে কোন প্রক্রিয়ায় অর্থ পরিশোধ ও রপ্তানি আয় দেশে আনা হবে তা জানা যাবে।